অনলাইন ডেস্ক:
দেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর এবার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশে কোনো সম্পদ আছে কিনা তার খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংস্থাটির কাছে প্রাথমিক তথ্য এসেছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বেনজীর পরিবারের সম্পদ থাকতে পারে। এ তথ্য নিশ্চিত হতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এছাড়া দেশেও বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের আরও বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে বাড্ডার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বেনজীরের সাত তলা একটি ভবনের খোঁজ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির অভিযোগ শিডিউলভুক্ত হলে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, অভিযোগ আমলযোগ্য হলে সেটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বুধবার সেগুনবাগিচায় সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করছে। আরও তদন্ত হবে। মামলা হলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কোনো অপরাধী শাস্তি ছাড়া পার পাবে না। অনেকে ভাবছে, বেনজীর আহমেদের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া, সে ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু তা হবে না। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে। তিনি আরও বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদক স্বাধীন তদন্ত করছে। দুদককে এ স্বাধীনতা শেখ হাসিনা সরকার দিয়েছে। তিনি বলেন, বেনজীর ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। কারণ সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারপ্রধান আপসহীন। সাবেক সেনাপ্রধানের বিষয়ে তিনি বলেন, যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, তিনিও যদি অপরাধী হন, তার বিরুদ্ধেও দুদক তদন্ত করতে পারবে। অপরাধী হলে শাস্তি পেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের সাবেক আইজিপি কিংবা সাবেক সেনাপ্রধান ব্যক্তি হিসাবে এককভাবে তারা এ দুর্নীতি করেননি। এর অংশীদার ও সুবিধাভোগী অনেকেই ছিলেন। আবার তারা দুজনই দুটি করে সংস্থার প্রধান ছিলেন। ফলে তারা যেসব সংস্থার প্রধান ছিলেন সেসব সংস্থার বিরুদ্ধে মানুষের আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হবে। তবে দুদক যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে এটা যেন লোক দেখানো না হয়। এই দুই ব্যক্তিসহ তাদের সঙ্গে যাদের যোগসাজশ রয়েছে তাদেরও যেন জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়।’
জানা গেছে, দেশের এক সময়ের ‘পাওয়ার হাউজ’ হিসাবে পরিচিত বেনজীর পরিবার এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি। আকস্মিকভাবে তার দুর্নীতি ও বিপুল সম্পদের তথ্য সামনে চলে আসায় পরিবারের সদস্যরা এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবে চলমান এই বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন সাবেক এই আইজিপি। দুদক জানায়, ইতোমধ্যে ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে দুদক। আদালতের নির্দেশে এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দুদকের এই কঠোর মনোভাব দেখে বেনজীরের ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার অনেক অজানা তথ্য সামনে চলে আসছে। এমনকি দুদক কার্যালয়েও বেনজীরের দুর্নীতি নিয়ে নতুন নতুন অভিযোগ জমা পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চাকরির শেষ ৩ বছরে বেনজীর দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠেন। পুলিশ বাহিনীর কেনাকাটা থেকে শুরু করে বদলি, পদোন্নতির সব ক্ষমতা পুলিশ সদর দপ্তরের অধীনে নিয়ে আসেন। কেনাকাটা, বদলি ও পদোন্নতি খাত থেকে তিনি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। বিশেষ করে পুলিশের কেনাকাটা খাত থেকে তিনি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। দুদকও এসব তথ্যের সত্যতা পেয়েছে। চাকরির শে ৩ বছরেই সবচেয়ে বেশি সম্পদ কিনেছেন বেনজীর আহমেদ। দুদক এখন পর্যন্ত বেনজীর পরিবারের ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩ ব্যাংক হিসাব এবং শেয়ার বাজারে ছয়টি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) পেয়েছে দুদক। আদালতের আদেশে এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদকের কাছে তথ্য আছে, বেনজীর আহমেদ আইজিপি থাকাকালে বিভিন্ন কেনাকাটার কমিশন বুঝে পাওয়ার পর টেন্ডার আহ্বানের অনুমতি দিতেন। এমনকি পুলিশের রেশন কেনার টেন্ডার থেকেও তিনি বিপুল কমিশন নিতেন। তার পছন্দের ঠিকাদার নিুমানের মাল সরবরাহ করলেও কারও কিছু বলার থাকত না। এসব তথ্য পাওয়ার পর দুদক তা খতিয়ে দেখছে।
দুদকের কাছে তথ্য এসেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় পাম জুমেরা এলাকায় বেনজীরের বাড়ি রয়েছে। এছাড়াও দুবাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসায় রয়েছে তার বিপুল বিনিয়োগ। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও সিঙ্গাপুরেও তিনি বিপুল অর্থ পাচার করেছেন। এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হতে বিএফআইইউয়ের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, বেনজীরের দুর্নীতির সঙ্গে আলোচনায় চলে এসেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তার দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে দুদকে আবেদন করেছেন সালাউদ্দিন রিগান নামের একজন আইনজীবী। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তফশিলভুক্ত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদক চেয়ারম্যান বরাবর করা ওই আবেদনে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী রিগান বলেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগে আজিজ আহম্মেদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণের সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশন এতবড় অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পরও অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যা দুদকের নিষ্ক্রিয়তা। এ বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে জানানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
জানা গেছে, ২১ মে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩ বছর বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন জেনারেল আজিজ আহমেদ। তার আগে ২০১২ সাল থেকে ৪ বছর বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির নেতৃত্ব দেন তিনি। তার ভাই ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হারিস ও জোসেফের নাম বদলে পাসপোর্ট করার বিষয়ে আজিজ আহমেদের সহযোগিতা ছিল বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া তার কারণেই জোসেফের সাজা মওকুফ করা হয়েছে-এমন আলোচনাও আছে। তথ্য সূত্র- দৈনিক যুগান্তর।